ড্যাপ ঢাকাকে ২০৩৫ সাল নাগাদ বাসযোগ্য নগরে পরিণত করতে চায়, আবাসন ব্যবসায়ীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও
ঢাকার সবচেয়ে জনবহুল এলাকাগুলোকে সংস্কারের প্রস্তাব রয়েছে ড্যাপ পরিকল্পনায়
এখন আবারো পরিকল্পনা সংশোধন করে ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান-ড্যাপ (২০১৬-৩৫) প্রণয়ণের উদ্যোগ নিয়েছে রাজউক। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মতামত নিয়ে খসড়া ড্যাপ প্রকাশ ও তাতে গণশুনানী শেষে তা চূড়ান্ত গতকাল (বৃহস্পতিবার) চূড়ান্ত অনুমোদনও দিয়েছে ড্যাপ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন শেষে শিগগিরই তা গেজেট আকারে প্রকাশ হবে।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, ওই ড্যাপেই ঢাকাকে বাসযোগ্য করার প্রস্তাব ছিল। ঢাকার আশেপাশের জলাশয় ও কৃষি জমি ছাড় দিয়ে আবাসন করার প্রস্তাব ছিল। ঢাকায় ৫৩০টি পুকুর ও ২২০টি খালকে জীবিত রাখার প্রস্তাব ছিল। রাস্তা, স্কুল, কলেজ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বিনোদন পার্ক ও খেলার মাঠের জন্য পৃথক জায়গা রাখা ছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯৯৭ সালের ওই পরিকল্পনা আলোর মুখ না দেখার কারণেই ক্রমেই বসবাস অযোগ্য হয়েছে ঢাকা শহর।
রাজউক জানিয়েছে ওই ড্যাপ না হওয়ায় গত দুই যুগে রাজধানী এবং এর আশেপাশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন লঙ্ঘন করে প্রায় ১০ হাজার একর জমি আবাসিক এলাকায় পরিণত হয়েছে। নদী, জলাশয়, আবাদী জমি, বনভূমি, ফ্লাড ফ্লো-জোন ও খাসজমি দখল করার পর বালু-মাটি ভরাট করে গড়ে উঠেছে পাঁচ শতাধিক আবাসন প্রকল্প।
১৯৯৭ সালে প্রকাশিত ওই ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানে গাজিপুর ও নারায়ণগঞ্জকে উপশহর ঘোষণা করাসহ ঢাকার পাশ্ববর্তী সাভার, পূর্বাচলকে রাজউকের অন্তভূক্ত করা হয়। আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকাসহ কৃষি, প্রাতিষ্ঠানিক, জলাশয়, বনাঞ্চল, উন্মুক্ত স্থান, বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে আবাসন নির্মাণের জায়গা নির্ধারণ করে দেয়া হয়।
তবে তা বাস্তবায়ন হলে নিন্মবিত্ত ও নিন্ম মধ্যবিত্ত শ্রেণি অনেক ভূমি হারিয়ে ফেলবে এ অভিযোগ তুলে বিরোধীতায় নামেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। গাজীপুর ও নারায়নগঞ্জ জুড়ে আন্দোলনে নামেন আবাসন ব্যবসায়ী ও ভূমির মালিকরা। ঢাকায় রাজউকের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন আবাসন ব্যবসায়ীরা।
প্রতিবাদের ফলে ড্যাপ সংশোধনের জন্য ২০১০ সালে ৭ জন মন্ত্রীকে নিয়ে ড্যাপ রিভিউ কমিটি গঠন করেন প্রধানমন্ত্রী। ওই কমিটিতে ড্যাপ সংশোধনের জন্য ২১৪৭টি আবেদন করেন আবাসন ব্যবসায়ী ও ভূমির মালিকরা। ফলে এটিকে সংশোধন করে নতুন করে ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান-ড্যাপ (২০১৬-৩৫) প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
রিহ্যাবের সহসভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, আগের ড্যাপটি বাস্তবতার নিরিখে ছিল না। বহু আবাসিক এলাকাকে জলাশয় ও কৃষি জমি হিসাবে চিহিৃত করা হয়েছিল। নগর বিশেষজ্ঞরাও ওই ড্যাপের বিরোধীতা করেছেন। ঘরে বসে পরিকল্পনা করায় তা আলোর মুখ দেখেনি।
নতুন ড্যাপে আরও যা আছে:
ঢাকার কেন্দ্রে জনসংখ্যার চাপ কমাতে সড়ক অবকাঠামোর ধারণক্ষমতা, বিদ্যমান নাগরিক সুবিধার ওপর ভিত্তি করে পরিকল্পনায় এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব জোনিং প্রণয়ন করা হয়েছে তাতে। এতে বিভিন্ন এলাকায় সুষম উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, নাগরিক সুবিধাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েই ড্যাপটি প্রণয়ন করা হয়েছে। বিশ্বের প্রায় সব মেগাসিটির ডিটেইল প্লান স্টাডি করেই আমাদের ড্যাপ সাজানো হয়েছে।
মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের পর স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব এবং বেজ ফার নির্ধারণ করা হয়েছে। কোনো এলাকাভিত্তিক ভবনের নির্দিষ্ট উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়নি। রাস্তা প্রশস্তকরণ এবং সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব এবং বেজ ফারের মান পুনঃনির্ধারণ করা হবে। ছয় তলার বেশি করা যাবে না এ কথা সঠিক নয়।
সব স্টেকহোল্ডারকে অন্তর্ভূক্ত করে ড্যাপ চূড়ান্ত করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, সব পক্ষের সাথে একাধিকবার বসে আলোচনা করে তাদের পরামর্শ এবং আপত্তি আমলে নিয়ে খসড়া ড্যাপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাদের আরো যদি কোনো চাহিদা থাকে এবং যেখানে দ্বিমত থাকে তবে সেগুলো সমাধান করা হবে।
তাজুল ইসলাম বলেন, নাগরিককে তাদের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে ঢাকায় আর অবকাঠামো নির্মাণ করতে দেওয়া হবে না। বসবাসের জন্য হুমকি হয় এমন কোনো কিছু করা যাবে না।
ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক বলেন, ড্যাপে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের আবাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ৫৪টি লোকেশনের চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় ৬৫০-৮০০ স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাট বানিয়ে সবার জন্য আবাসন নিশ্চিত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
আবাসন কোম্পানি এবং রাজউকের নিজস্ব উদ্যোগে আবাসন ব্যবস্থা গড়ে বিশেষ ইনসেনটিভের মাধ্যমে নিন্মবিত্ত মানুষের মধ্যে হস্তান্তর করা হবে বলে উল্লেখ করেন ড্যাপ প্রকল্প পরিচালক।
নতুন ড্যাপে উত্তর-দক্ষিণে গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকা, পশ্চিমে সাভারের বংশী নদী এবং পূর্বে কালীগঞ্জ-রূপগঞ্জ যা শীতলক্ষ্যা নদী বেস্টিত এলাকা এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে কেরাণীগঞ্জকে রাজউকের অন্তভূক্ত করা হয়েছে।
এতে রাজউকের ১৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে নগর ধরা হয়েছে ৬০ শতাংশ এলাকাকে। পরিবেশের কথা মাথায় রেখে মোট ভূমির মধ্যে আবাসিক এলাকা ৪.৩৬ শতাংশ, মিশ্র ব্যবহার এলাকা (আবাসিক প্রধান) ৩২.৫০ শতাংশ, মিশ্র ব্যবহার এলাকা (আবাসিক-বাণিজ্যিক) দশমিক ৪৫ শতাংশ, বাণিজ্যিক এলাকা দশমিক ১৬ শতাংশ, মিশ্র ব্যবহার এলাকা (বাণিজ্যিক প্রধান) ১.৪৩ শতাংশ, মিশ্র ব্যবহার এলাকা (শিল্প প্রধান) ৭.৯০ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক এলাকা ৪.১ শতাংশ, ভারী শিল্প এলাকা ১.৬৩ শতাংশ, পরিবহন যোগাযোগ (বিদ্যমান) ৫.২৫ শতাংশ, পরিবহন যোগাযোগ (প্রস্তাবিত) ২.৩৫ শতাংশ, কৃষি এলাকা ২৯.২২ শতাংশ, জলাশয় ৭.৯৫ শতাংশ, বনাঞ্চল ১.৪১ শতাংশ, উন্মুক্ত স্থান ১.৩৮ শতাংশ রাখা হয়েছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা ও ট্রানজিট ভিত্তিক উন্নয়ন:
ড্যাপ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এখন আন্তঃআঞ্চলিক সংযোগকারী রাস্তা রয়েছে প্রায় ২২৮ কিলোমিটার। নতুন প্রস্তাবিত ড্যাপে আরও প্রায় ৬৩ কিলোমিটারসহ মোট ২৯১ দশমিক ৭৪৩ কিলোমিটার রাস্তা প্রস্তাব করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ আঞ্চলিক সংযোগ সড়ক ২৫১ কিলোমিটার বাড়ানো হয়েছে।
সংগ্রাহক রাস্তা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হযেছে ১,২০০ কিলোমিটার। মেট্রো স্টেশন, রেলওয়ে স্টেশন, বাস টার্মিনাল বা নদীবন্দর সংলগ্ন এলাকাকে ট্রানজিটভিত্তিক ডেভেলপমেন্ট এলাকা হিসাবে প্রস্তাবনা করা হয়েছে।
পথচারী ও অযান্ত্রিক যান চলাচলের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ২০২ কিলোমিটার সড়কে সাইকেল লেন নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। ৫৭৪ কিলোমিটার নৌ-চলাচলের উপযোগী নৌপথ উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে।
স্কুল, কলেজ পার্ক-বিনোদন:
পরিবেশবান্ধব শহর তৈরির লক্ষ্যে পরিকল্পনায় পাঁচটি বড় আঞ্চলিক পার্ক, ৪৯টি জলকেন্দ্রীক পার্ক, আটটি বৃহৎ ইকোপার্ক (ভাওয়াল বনসহ), ৯টি অন্যান্য পার্ক এবং খেলার মাঠ নির্মাণের প্রস্তাবনা করা হয়েছে। সব মানুষের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পূর্ণাঙ্গ খেলার মাঠসহ অঞ্চলভিত্তিক ৬২৭টি বিদ্যালয় এবং ২৮৭টি হাসপাতালের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়াও নতুন ড্যাপে বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে ঢাকার জন্য সাংস্কৃতিক বলয় তৈরির প্রস্তাব করা হয়েছে। ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণ করে সেগুলোকে পর্যটন ও বিনোদনের কেন্দ্রে পরিণত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
আবাসন ব্যবসায়ীদের আপত্তি যেখানে:
ড্যাপ নিয়ে আবাসন ব্যবসায়ীদের আপত্তি মূলত এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব জোনিং করে ভবনের উচ্চতা এবং পরিমাপ নির্ধারণ করে দেওয়া নিয়ে। তাদের দাবি, নতুন প্রস্তাবনা বাস্তবায়িত হলে ভবনের আয়তন এখন যা অনুমোদন হচ্ছে- তা থেকে কমপক্ষে ৩৩-৫৩ শতাংশ কমে যাবে।
উদাহরণ দিয়ে রিহ্যাব সভাপতি বলেন, এখন ২০ ফুট রাস্তা সংলগ্ন পাঁচ কাঠা জমিতে গ্রাউন্ড ফ্লোরসহ আট তলার ভবনে মোট ১৩,৫০০ বর্গফুট নির্মাণের অনুমতি পাওয়া যায়। প্রস্তাবিত বিধিমালা অনুযায়ী ওই জায়গায় ৫ তলা ভবনে মোট ৯,০০০ বর্গফুট ভবন নির্মাণের অনুমতি পাওয়া যাবে।
২০ ফুট এর চেয়ে ছোট রাস্তার ক্ষেত্রে ভবনের উচ্চতা ৩/৪ তলার বেশি হবে না এবং আয়তন অনেক কমে যাবে। এমন চিত্র প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই হবে। এতে নির্মাণযোগ্য ফ্ল্যাট সংখ্যা কমে আসার কারণে ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। তখন ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন:
চূড়ান্ত অনুমোদনের পর নতুন ড্যাপ দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার বলে মনে করেন নগর বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, নতুন ড্যাপে কিছু বিষয় যুক্ত করা হয়েছে যা অবশ্যক ছিল। তবে উদ্যোগগুলো কতটা বাস্তবায়ন হবে তার ওপর নির্ভর করবে এই শহরের ভবিষ্যৎ।